“আমি চেয়েছি ঘৃণা বা রাগ নয়, বরং ভালবাসা, শান্তি এবং সম্প্রীতির নিদর্শন রাখতে”: ফরিদ আহমেদ

Farid Ahmed met Australian Prime Minister Scott Morrison in Sydney earlier 2020.

Farid Ahmed met Australian Prime Minister Scott Morrison in Sydney in 2020. Source: Facebook/Scott Morrison (ScoMo)

হুসনা আহমেদ ১৫ ই মার্চ, ২০১৯ সালের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে এক নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন। হুইলচেয়ারে থাকা স্বামী ফরিদ আহমেদকে খুঁজতে গিয়ে তিনি প্রার্থনারত আরো অন্যান্য ৫১ জনের সাথে এক ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। পেশায় একজন হোমিওপ্যাথিক হেলথ কনসালটেন্ট এবং ইসলাম প্রচারক মি. ফরিদ আহমেদ কিন্তু সেই অভিযুক্ত ও প্যারোল-বিহীন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড-প্রাপ্ত ঘাতককে তার নিজের দিক থেকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।


গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো

  • ২০১৯ সালের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে এক নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার সময়ে হুইলচেয়ারে থাকা স্বামী ফরিদ আহমেদকে খুঁজতে গিয়ে হুসনা আহমেদ আরো ৫০ জনের সাথে নিহত হয়েছিলেন।
  • অভিযুক্ত ও প্যারোল-বিহীন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড-প্রাপ্ত ঘাতককে নিজ পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ফরিদ আহমেদ।
  • তিনি তার রচিত 'হুসনা'স স্টোরি - মাই ওয়াইফ, দা ক্রাইস্টচার্চ ম্যাসাকার এন্ড মাই জার্নি টু ফরগিভনেস’ বইটি থেকে তার অর্জিত অর্থ এম্বুলেন্স সার্ভিসকে দান করেছেন।
ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডির প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও ক্ষমা, শান্তি এবং প্রেমের দর্শন কীভাবে বিশ্বাস এবং মানবিকতা সৃষ্টি করতে পারে তার উদাহরণ হয়ে উঠেছেন মি. ফরিদ আহমেদ।

ফরিদ আহমেদ তার রচিত 'হুসনা'স স্টোরি - মাই ওয়াইফ, দা ক্রাইস্টচার্চ ম্যাসাকার এন্ড মাই জার্নি টু ফরগিভনেস' বইতে তার স্ত্রী হুসনা আহমেদের সেদিনের সাহসিকতা এবং কমিউনিটির প্রতি তার অবদান তুলে ধরেছেন।

সেদিনের সেই নারকীয় ঘটনা ক্রাইস্টচার্চ হত্যাযজ্ঞের দু'বছর পূর্ণ হয়েছে গত ১৫ মার্চ ২০২১ এ। মি. আহমেদও তার স্ত্রী হুসনা আহমেদের ঘাতককে তার নিজের দিক থেকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আরো দেখুন:

সেদিন হুসনা আহমেদের প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত সাহসী এবং নিঃস্বার্থ। তিনি সেখানে থাকা অন্যান্য নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপর তিনি হুইলচেয়ারে থাকা তার স্বামীকে খুঁজতে যান, আর তখনি তিনি ঘাতকের গুলিতে নিহত হন।

হুসনা আহমেদ কমিউনিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। স্বামী ফরিদ আহমেদ দুর্ঘটনায় পড়ে সুস্থ হলেও হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। তার এবং নিজ কন্যার দেখভাল ছাড়াও কমিউনিটির নারীদের সাহায্য এবং শিশুদের পড়াশোনার জন্য ক্লাসও নিতেন হুসনা আহমেদ।
In his book 'Husna's Story - My Wife, The Christchurch Massacre and My Journey to Forgiveness', Farid Ahmed highlights the courage of his wife Husna Ahmed.
In his book 'Husna's Story - My Wife, The Christchurch Massacre and My Journey to Forgiveness', Farid Ahmed highlights the courage of his wife Husna Ahmed. Source: Farid Ahmed
মুসলিম সমাজে হুসনা আহমেদের এই ইতিবাচক অবদান নিয়ে ফরিদ আহমেদ 'হুসনা'স স্টোরি' শীর্ষক যে বইটি রচনা করেছেন,  সেটি প্রকাশ করেছে এলেন এন্ড আনউইন।

বইটি প্রকাশের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এসবিএস বাংলাকে মি. ফরিদ আহমেদ বলেন, ওই সময়ের ঘটনায় শুধু তিনিই নন, তার পরিবারের সদস্যরা তথা পুরো কমিউনিটিই ভেঙ্গে পড়েছিলো।

“সেই সময় আমার চিন্তা ছিল এ ঘটনা কীভাবে আমি মানবতার কাছে তুলে ধরবো। যেহেতু আমার স্ত্রী আল্লাহ্‌র পথে শহীদ হয়ে গেছেন, কিন্তু আমি কী করতে পারি।”

মি. আহমেদ এ প্রসঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র হাদীস থেকে কিছু ব্যাখ্যা দেন যে, মানুষ মারা গেলে তিন উপায়ে তার জন্য সওয়াব বা পুণ্য পৌঁছানো যায়: ‘সাদাকা’ বা দান, জ্ঞান বিতরণ এবং দোয়া বা প্রার্থনা।

“তখন আমি ভাবলাম, একটি বই লিখব যার মাধ্যমে সাদাকা বা দান এবং জ্ঞান বিতরণ করা সম্ভব হবে…এই বই থেকে আমার প্রাপ্ত অর্থ আমি এম্বুলেন্স সার্ভিসে দিয়ে দেব। এতে দরিদ্র, অসহায় এবং অসুস্থ লোকেরা সহায়তা পাবে। সেই সাথে ওই দিন আমি যা দেখেছি তার একটা লিখিত দলিল থাকার প্রয়োজন আমি বোধ করেছি। আমি সেই ম্যাসাকারের অনেক কিছু দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, যদি আমি না লিখি, তবে ইতিহাস থেকে ওই ঘটনার দলিল হারিয়ে যেতে পারে।”
Mr. Ahmed's "Idea of ​​forgiveness" has attracted the attention not only of the world's media, but also of various communities and heads of government.
Mr. Ahmed's "Idea of forgiveness" has attracted the attention not only of the world's media, but also of various communities and heads of government. Source: Farid Ahmed
তিনি বলেন, “আমি চেয়েছি ঘৃণা বা রাগ দিয়ে নয়, বরং ভালবাসা, শান্তি এবং সম্প্রীতির নিদর্শন রাখতে।”

ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে গুলিবর্ষণকারী ব্রেনটন ট্যারেন্ট একাই ৫১ জন ব্যক্তিকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন মি. আহমেদ ক্ষমার পথে গেলেন, কেন তার প্রতি এই অনুকম্পা, আর এর তাৎপর্যই বা কী?

এই প্রসঙ্গে মি. আহমেদ বলেন, এটা তার নিজের কাছেও প্রশ্ন ছিল, এছাড়া অনেকের কাছেই তিনি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন।

কেউ যদি হত্যা করে তবে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল্ কুরআনে তিনটি পথ খোলা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “…আমি বিশ্ববাসীর কাছে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম কুরআনের আলোকে, কুরআনের সুরা আল বাকারায় যে তিনটি বিকল্প উল্লেখ আছে তা হচ্ছে, কিসাস বা জাস্টিস সিস্টেম কিংবা বদলা গ্রহণের ব্যবস্থা, ক্ষতিপূরণ বা দিয়াদ এবং আল্লাহর ওয়াস্তে ক্ষমা করে দেয়া।”

মি. আহমেদ বলেন, “যেহেতু আল্লাহ্‌ পাক কুরআন শরীফে একটি বিকল্প দিয়েছেন, এবং ক্ষমা করতে উৎসাহিত করেছেন, তখন আমার মনে হল এই বিকল্পটি গ্রহণ করতে পারি - সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই ক্ষমার করার বিষয়টি এসেছে, এটাই ইসলামের একটি শিক্ষা।”

আরো দেখুন:

“আমি চেয়েছিলাম ইসলামের যে শিক্ষা ওটা প্রকাশ করতে। আল্লাহ্‌ বলেছেন, তোমার প্রতি যদি কেউ মন্দ করে তবে তার বিপরীতে তুমি ভাল করো। … তো আমি ভাবলাম সে আমার পরিবার এবং কমিউনিটির প্রতি দিয়েছে ঘৃণা, কিন্তু আমি ঘৃণার বদলে ভালবাসা দেবো।”

তিনি বলেন, ইসলাম একটা শান্তির ধর্ম, ইসলাম ক্ষমা শেখায়, এই বিষয়টি জানা প্রয়োজন ছিল।

ইসলাম সম্পর্কে অনেক ভুল বোঝাবুঝি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসলাম বা মুসলিম মানে 'সন্ত্রাসী' বা তারা ‘খুন করে’ - এই ধারণা ভেঙ্গে দেয়ার প্রয়োজন ছিল একটি উদাহরণ দিয়ে।

“আমি বলতে চেয়েছি, দেখো, ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম, ক্ষমা সবসময় হৃদয় জয় করে, শান্তি আনে। প্রতিশোধের যে ধারাবাহিকতা, তা ভাঙ্গে।”
Christchurch massacre aftermath (File Photo)
New Zealand Prime Minister Jacinda Ardern meets with members of the Muslim community in Christchurch in the wake of the mass shootings (File Photo). Source: Office of the Prime Minister NZ
এই ঘটনার দু’বছর পেরিয়ে গেছে, পরিবর্তিত হয়েছে মি. আহমেদের জীবন। তার ‘ক্ষমার ধারণা’ বিশ্বের গণমাধ্যমেই শুধু নয়, বিভিন্ন কমিউনিটি এবং সরকার প্রধানদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি সাক্ষাৎ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তিনি শান্তির বার্তা নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য প্রদান করেন, সেখানে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিটির কাছে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাসমূহ দূর করার চেষ্টা করেন।

“আমার জীবনে সবচেয়ে যে বড় পরিবর্তন এসেছে, তা হচ্ছে আমার কাজ বেড়ে গেছে। আমি এবং আমার স্ত্রী প্রায় ২১ বছর মসজিদে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছি। এখন এই ঘটনার পর আমার বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দেয়ার আমন্ত্রণ বেড়ে গেছে।”

মি. আহমেদ জানান, মুসলিম তো অবশ্যই, অনেক অমুসলিম কমিউনিটি থেকেও তিনি কথা বলার আমন্ত্রণ পান।

“তারা বুঝতে চান, ইসলাম আমাদের কী শিক্ষা দেয় যে আমরা এত কিছুর পরেও দুঃখ পাই না, বিষণ্ণ হই না, আত্মহত্যা করি না, কীভাবে আমরা হাসতে পারি। কীভাবে আমরা এখনো ভয় না পেয়ে মসজিদে যাচ্ছি।”
A woman pauses as she lays flowers on a wall at the Botanical Gardens in central Christchurch (File Photo).
A woman pauses as she lays flowers on a wall at the Botanical Gardens in central Christchurch (File Photo). Source: AP
১৯৮৮ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে বাস করছেন মি. ফরিদ আহমেদ। তিনি জানান, প্রথমদিকে সেখানে থিতু হতে বেশ কষ্ট করেছেন। সেসময় নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজন ছিল হাতে গোনা।

মি. আহমেদ প্রায় ২১ বছর আগের আরও একটি দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তখন এক মদ্যপ গাড়ি-চালক তাকে চাপা দেয়। ডাক্তাররা তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র ৭ শতাংশ বললেও অলৌকিকভাবে তখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। কিন্তু তাকে সবসময়েই চলাফেরা করতে হয় হুইলচেয়ারে।

মি. ফরিদ আহমেদ তার শারীরিক বাধা সত্ত্বেও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছেন এবং নিজ বাড়িতে তিনি প্র্যাকটিস করেন। তিনি ক্রাইস্টচার্চের ডীনস এভেনিউ মসজিদের একজন সিনিয়র লিডার এবং সারা বিশ্বে ক্ষমা এবং ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করছেন।

তিনি এসবিএস বাংলার শ্রোতা ও পাঠকদের তার রচিত 'হুসনা'স স্টোরি - মাই ওয়াইফ, দা ক্রাইস্টচার্চ ম্যাসাকার এন্ড মাই জার্নি টু ফরগিভনেস’ বইটি পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

একজন তামিলভাষী শিক্ষাবিদ তার বইটি অনুবাদ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, কেউ যদি তার বইটি বাংলায় অনুবাদ করে বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেন তাহলে তিনি আনন্দিত হবেন।

মিঃ ফরিদ আহমেদের পুরো সাক্ষাৎকারটি শুনতে ওপরের অডিও লিংকে ক্লিক করুন।

আরো দেখুন:



 


Share