অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা বা স্কলারশীপ: পিছিয়ে আছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

অস্ট্রেলিয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে পড়াশোনা বা বৃত্তিলাভের বেশ সুযোগ আছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসার হার তুলনামূলক কম। এই প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে যারা পড়তে এবং গবেষণা করতে আসবেন তাদের বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন শিক্ষাবিদ।

Students in lecture room (File image)

Students in lecture room (File image) Source: AAP

অস্ট্রেলিয়া পড়াশোনার জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় দেশ। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশটির শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, খাতটি হারিয়েছে বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব। তবে সাম্প্রতিক সময়ে স্টুডেন্ট ভিসার নিয়ম পরিবর্তন এই দেশের শিক্ষাখাতে আশার সঞ্চার করেছে। 

যে কারণেই হোক দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়ায় কম। অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষাবিদরা মনে করেন যারা অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে ইচ্ছুক তাদের কিছু বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন। 

ফেডারেশন ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া'র স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন এন্ড ফিজিক্যাল সাইন্সেস বিভাগের সেশনাল একাডেমিক ডঃ আব্দুল্লাহি আল কাফী চৌধুরী মনে করেন, নিজস্ব অর্থায়ন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ায় স্কলারশীপেও পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়, কিন্তু অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এই সব সুযোগগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, কিংবা আবেদনের সঠিক পথটা কি তা জানে না।   

ইউনিভার্সিটি বা TAFE-গুলোতে ভর্তির জন্য যেসব বিষয় জানা জরুরী 

ইংলিশ স্কোর:

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি বা TAFE-গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে ইংরেজিতে দক্ষতা দেখা হয়। ইউনিভার্সিটি বা TAFE-গুলো সাধারণত আইইএলটিএস একাডেমিক স্কোর গড়ে ৬ বা ৬.৫ চায়। এটি নির্ভর করে কোন বিষয়ে তারা পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভেদে এই স্কোর ভিন্ন হতে পারে। অনেক সময় এই স্কোর তাদের না থাকলেও ইংরেজির দক্ষতাভেদে তাদের অতিরিক্ত ইংলিশ কোর্স অফার করা হয়। শিক্ষার্থীরা ইউনিভার্সিটিগুলোর ওয়েবসাইটে গিয়ে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে পারেন। 

আন্ডারগ্রাজুয়েট বা ব্যাচেলর কোর্স: 

ইউনিভার্সিটি বা TAFE-গুলোতে আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্সে ভর্তির জন্য বাংলাদেশের এইচএসসি যথেষ্ট যা অস্ট্রেলিয়ার ইয়ার ১২-এর সমতুল্য।  

সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর অফ মাস্টার্স অফ ফিন্যান্স এন্ড ব্যাঙ্কিং ডঃ সরোদ খন্দকার বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা পড়াশোনা করতে আসতে চায় তারা কি কি স্ট্রীমে পড়তে পারে সে বিষয়ে তাদের খোঁজ নেয়া প্রয়োজন। 

তিনি বলেন, "বাংলাদেশ থেকে যারা এইচ এস সি পাশ করে আসবেন তাদের পড়াশোনা অস্ট্রেলিয়ান ইয়ার ১২-এর সমতুল্য ধরা হয়, তাই তাদের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাচেলরে ভর্তি সহজতর। কিন্তু কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে ইতিমধ্যে ব্যাচেলর করে ফেলে তখন কিছুটা জটিলতা দেখা যায়, কারণ তারা যখন মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হবেন তাদের জন্য শর্ত হচ্ছে তাদের ডিগ্রী অস্ট্রেলিয়ান ব্যাচেলরের সমতুল্য হতে হবে। এক্ষেত্রে সে বাংলাদেশের কোন ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর ডিগ্রী করেছে তার কোয়ালিটি পরীক্ষা করা হয়।" 

তবে ব্যাচেলর ডিগ্রী সমতুল্য না হলেও তাদের কিছু বিকল্প থাকে। 

ডঃ খন্দকার বলেন, "এক্ষেত্রে তাদের পাথওয়ে অপশন রয়েছে, অস্ট্রেলিয়ান অধিকাংশ ইউনিভার্সিটিগুলোতে প্রি-মাস্টার্স কোর্স আছে। যেমন সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটিতে প্রি-মাস্টার্স কোর্সে চারটি অতিরিক্ত কোর্স করতে হয় যার মাধ্যমে তাদের মূল মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য প্রস্তুত করা হয়।"
Dr Sarod Khandaker
Dr Sarod Khandaker Source: Dr Sarod Khandaker
ডঃ সরোদ খন্দকার বলেন, "বাংলাদেশ থেকে যারা এইচ এস সি পাশ করে আসবেন তাদের অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ করে চাকরীর সুযোগ বেশী থাকে। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ ইউনিভার্সিটিগুলোর ইন্ডাস্ট্রি বেসড লার্নিং (আইবিএল) প্লেসমেন্ট প্রোগ্রামও আছে, একসময় এই প্রোগ্রামগুলো অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষার্থীদের দেয়া হতো, এখন সেগুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরও দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ব্যাচেলর প্রোগ্রামের অন্তত একবছর তারা এই প্লেসমেন্টের সুযোগ পাবে। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে যেসব প্রতিষ্ঠানে তারা প্লেসমেন্টের সুযোগ পায় তারাই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষে নিয়োগ দেয়।" 

ডঃ খন্দকার বলেন, এই আইবিএল প্লেসমেন্টগুলো শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গড়তে আত্মবিশ্বাস তৈরী করে দেয়। 

পিএইচডি এবং স্কলারশীপের জন্য যেসব বিষয় জানা জরুরীঃ 

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ফেলো মোল্লা মোঃ রাশিদুল হক বলেন, ইউনিভার্সিটিগুলোতে রিসার্চ বা পিএইচডি করতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজিতে দক্ষতা ছাড়াও তাকে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, যেমন তার গবেষণা এবং পাবলিকেশন। 

তিনি বলেন, "মূল পয়েন্টগুলো হচ্ছে তার ভালো আইইএলটিএস স্কোর থাকতে হবে, তার ডিগ্রি H1 (অস্ট্রেলিয়ান প্রথম শ্রেণীর অনার্স ডিগ্রী) সমতুল্য হতে হবে, বিভিন্ন স্বীকৃত জার্নালে তার কিছু রিসার্চ পাবলিকেশন থাকতে হবে, তারপর তার কাজ হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন প্রফেসর বা ফ্যাকাল্টি মেম্বার-গবেষকের সাথে যোগাযোগ করা যিনি তার পিএইচডি গবেষণা সুপারভাইজ করবেন।"
Molla Huq
Molla Huq Source: Molla Huq
অস্ট্রেলিয়ায় নিজস্ব অর্থায়ন ছাড়াও বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। 

ফেডারেশন ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া'র ডঃ আব্দুল্লাহি চৌধুরী বলেন, অনেক মাস্টার্স বা পিএইচডি গবেষকরা তাদের থিসিস, গবেষণা বা পাবলিকেশন ঠিকমত রক্ষনাবেক্ষন করেন না, কিংবা তাদের অর্জনগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। 

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অনেক রিসার্চ ফোরাম আছে যারা এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারেন, উচ্চতর শিক্ষার্থীদেরকে তাদের গবেষণাগুলো পাবলিকেশনে উদ্বুদ্ধ এবং সহায়তা করতে এবং সঠিক গাইডলাইন দিতে পারেন।”
Dr Abdullahi Chowdhury
Dr Abdullahi Chowdhury Source: Dr Abdullahi Chowdhury
ডঃ আব্দুল্লাহি চৌধুরী মনে করেন, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পাবলিকেশন বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হলে ইউনিভার্সিটিগুলোর র‍্যাঙ্কিং যেমন বাড়বে, তেমনি অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে স্কলারশীপ পাওয়া অনেক সহজ হবে। 

তিনি বলেন, বিভিন্ন স্ট্রীমে, বিভিন্ন কোম্পানি স্কলার শীপ দেয়, কিন্তু অনেক বাংলাদেশিরা এগুলো জানেই না।  অথচ, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেশগুলোর শিক্ষার্থীরা এই সুযোগগুলো  ভালোভাবে ব্যবহার করছে।

“শিক্ষার্থীদের উচিত স্কলারশীপের এই সুযোগগুলো সম্পর্কে ভালভাবে খোঁজ নেয়া, তারা ফুল স্কলারশীপ না পেলেও পার্ট স্কলারশীপ বা টিউশন ফী মওকুফও পেতে পারেন।"  

ডঃ আজিজ রহমান ফেডারেশন ইউনিভার্সিটির পাবলিক হেলথ বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর।  

তিনি বলেন, স্কলারশীপের অস্ট্রেলিয়া সরকারের অনেকগুলো প্রোগ্রামের একটি ডেস্টিনেশন অস্ট্রেলিয়া, এটি মূলত রিজিওনাল এলাকাগুলোর জন্য, এছাড়া অনেকগুলো অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রামও আছে। 

ডঃ রহমান বলেন, "কেউ মাস্টার্সের পরে পিএইচডি করার জন্য আবেদন করতে পারেন, তবে এটি নিজস্ব অর্থে পড়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এজন্য তারা বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারেন।"

ডঃ রহমান বলেন, অনেক সময় বাংলাদেশের মাস্টার্স ডিগ্রীকে অস্ট্রেলিয়ান অনার্স ডিগ্রীর সমতুল্য দেখানো যেতে পারে। সাধারণত কারো ফলাফলে শতকরা ৭০ ভাগ স্কোর থাকলে সেটাকে পিএইচডির জন্য বিবেচনা করা হয়। এছাড়া কেউ যদি স্কলারশীপের জন্য আবেদন করতে চান তবে তার স্কোর হতে হবে অন্তত শতকরা ৮৫ ভাগ।
Dr Aziz Rahman
Dr Aziz Rahman Source: Dr Aziz Rahman
ডঃ রহমান তার অভিজ্ঞতা থেকে পাবলিক হেলথ বিষয়ে পিএইচডি এবং বৃত্তির আবেদনকারীদের উদ্দেশ্যে কিছু মানদণ্ডের বিষয় উল্লেখ করেন। 

তিনি বলেন, পিএচডি এবং স্কলারশীপের জন্য যারা আবেদন করেন তাদের মাস্টার্স করার সময়ে যেসব থিসিস, গবেষণা বা কোন পাবলিকেশন থাকে সেগুলো অনেক সময় তারা গুরুত্ব দিয়ে করেন না যার জন্য পরবর্তীকালে তাদের বেগ পেতে হয়।  

তিনি বলেন, ইউনিভার্সিটিগুলো সেই গবেষণাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। কারণ ইউনিভার্সিটিগুলো যখন দেখে তাদের গবেষণায় যথেষ্ট অভিজ্ঞতা বা গভীরতা নেই, তখন তাদের থিসিস বা গবেষণাগুলো আবার মূল্যায়ন করে থাকেন দুজন স্বতন্ত্র ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সেখানে তাদের পিএচডির জন্য ৭০ ভাগ এবং বৃত্তির জন্য ৮৫ ভাগ স্কোর পেতে হবে।  

ডঃ রহমান বলেন, পিএচডি এবং স্কলারশীপের জন্য আবেদনকারীদের গবেষণার অভিজ্ঞতা এবং পাবলিকেশন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। 

"আমার পরামর্শ যাদের মাস্টার্সে রিসার্চ আছে তারা যাতে সেটা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে করেন।" 

ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য প্রতিষ্ঠান এবং বিষয়ভেদে আইইএলটিএস স্কোর ৬.৫ ছাড়াও রিসার্চ বা পিএইচডি'র জন্য গবেষণার বিষয়বস্তু এবং সুপারভাইজারও প্রয়োজন হয়। 

ডঃ রহমান বলেন, "প্রথমে খোঁজ করতে হবে তার গবেষণার জন্য কোন সুপারভাইজার তাকে সাহায্যে করতে প্রস্তুত। তবে এটি দুভাবে হতে পারে, অনেক সময় অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করার সময় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় এবং এজন্য বিষয়বস্তুও দিয়ে দেয়া হয়, এবং সে অনুযায়ী আবেদনকারীরা নির্বাচিত হন। আরেকটি উপায় হচ্ছে - নিজের কোন টপিক, এজন্য আবেদনকারীকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বা সম্ভাব্য ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের নিকট আবেদন করতে হবে। সেক্ষেত্রে তাকে কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয় যার মাধ্যমে আবেদনকারীর গবেষণার অভিজ্ঞতা যাচাই করা হয় এবং পিএইচডি'র জন্য গৃহীত হয়।" 

অস্ট্রেলিয়ায় স্কলারশীপের জন্য ভিজিট করুনঃ  অথবা

আরও দেখুনঃ 



Share
Published 28 September 2020 6:16pm
By Shahan Alam
Presented by Shahan Alam

Share this with family and friends